পান ও সুপারি খাওয়াটা কি উপকারী না অপকারী ?
আয়ুর্বেদ ও অধুনিক গবেষণানুযায়ি পান ও
সুপারির অনেক উপকারিতা রয়েছে। এমনকি ওষুধের মতো এদের ব্যবহার করা যায়। আয়ুর্বেদে
প্রতিদিন দাঁত মাজা, স্নানের মতো পান খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মানুষের ভুল
ব্যবহারের জন্য সেটা আজ শুধু অপকারিতাই নয়, মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সারা বিশ্বে প্রায় নব্বই প্রজাতির পান দেখা যায়। যার মধ্যে ভারতেই
পয়তাল্লিশটি প্রজাতি রয়েছে। এর বৈজ্ঞানিক নাম পাইপার ব্যাটেল (Piper betle) আর সংস্কৃত নাম তাম্বুল। আবার বৈদিক নাম সুপ্তশিরা। কারণ সব পানেই সাতটি
প্রধান শিরা দেখা যায়। সুশ্রুত সংহিতা (Sushruta Samhita) অনুসারে পান গলার স্বর
ভালো রাখে, হজম শক্তি বাড়ায়, কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়, রুচিনাশক, বল কারক, কফ নাশক, মুখ
দুর্গন্ধ নাশক, বাত কমায়, ক্লান্তি দূর করে। শুধু খাওয়া না পানকে বেটে তার রস দিয়ে
দাঁতের মাড়ির ক্ষয়, ব্যাথা বেদনায়, একজিমা, পুরানো দাদ, কানের পুঁজ, পায়ের হাজ,
মাথার উকুন ইত্যাদি দূর করা যায়। পান খাওয়ার সব থাকে সঠিক সময় হল ঘুম থেকে উঠার
পর, খাওয়ার পর, সহবাসের পর। তবে যারা হার্টের পেসেন্ট, রক্তে রোগ আছে, চোখ লাল হয়,
বারে বারে অজ্ঞান হওয়ার প্রবনাতা আছে তাদের পক্ষে পান খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পান
আবার বেশি খেলে বল ক্ষয় হয়, হজম ক্ষমতা কমে, শ্রুতি শক্তি কমে, চুল ও দাঁতের ক্ষতি
হয়, পিত্ত ও রক্তের রোগ হয়। আধুনিক গবেষণায় পানের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে ইউজেনল
(eugenol), ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, লোহা, আয়োডিন, ভিটামিন এ, বি, সি
ইত্যাদি বহু গুরুত্বপূর্ণ উপাদনের সন্ধান পাওয়া গেছে। পানে অ্যান্টি অ্যালার্জিক
(Anti allergic), অ্যান্টি ম্যালেরিয়াল (Anti malaria), অ্যান্টি ক্যানসার (Anticancer), অ্যান্টি ডায়াবেটিক (Anti diabetic), অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট (Antidepressants), ওরাল হাইজিন (Oral hygiene) রক্ষা করা, ওজন কমানো (Weight loss),
ব্যাথা বেদনা দূর করা ইত্যাদি গুনাগুন খুঁজে পাওয়া যায়।
এবার সুপারিতে আসা যাক, বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থার (WHO) পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে ৬০ কোটি (600 million) মানুষ সুপারি খায়। সে পানের সাথেই হোক বা অন্যভাবেই হোক। প্রায় পাঁচশত
খ্রিষ্টপূর্বাব্দেও যে সুপারির ব্যবহার হত তার সন্ধান পাওয়া গেছে। সারা বিশ্বে সব
থেকে বেশি সুপারি উৎপাদন হয় ভারতে, প্রায় ৪৯.৪৭ শতাংশ। এর বৈজ্ঞানিক নাম অ্যারেকা
ক্যাটেচু (Areca catechu) আর সংস্কৃত নাম গুবাক এবং পুগ। সুশ্রুত সংহিতা (SushrutaSamhita) অনুসারে এটি চোয়াল, দাঁত ও জিভার শক্তি বাড়ায়। হজম কারক, কোষ্ঠকাঠিন্য
কমায়, খিদে বাড়ায়, রুচি বাড়ায়, কফ, পিত্ত, কৃমি নাশ করে। এটি গলা ব্যাথা, বাতের ব্যাথাতেও
বেশ উপকারি। তবে এটি দৃষ্টির পক্ষে ক্ষতিকারক। কাঁচা সুপারি কখনো খাওয়া উচিত নয়
কমপক্ষে তিন মাস পুরান সুপারি খাওয়া ভালো। আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী সুপারিতে রয়েছে
ট্যানিন (Tannin), গ্যালিক অ্যাসিড (Gallic acid), আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফটের মতো
উপাদনগুলি। পানের মতো সুপারিতেও রয়েছে অন্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxident), অ্যান্টি
ম্যালেরিয়াল (Anti malaria), অ্যান্টি অ্যালার্জিক (Anti allergic), অ্যান্টি
ডিপ্রেসেন্ট (Anti depressants), ক্ষত বা আলসার নিরাময় করার মত ক্ষমতা।
সুতরাং
পান সুপারিতে এতো উপকার থাকা সত্ত্বেও মানুষ প্রতিদিন ক্যানসারের মতো মারণ রোগে
অক্রান্ত হচ্ছে। কেন ? কারণ মানুষ শুধু চুন সুপারি দিয়ে পান খায় না। খায় অনেক কিছু
মিশিয়ে, যেমন- ধনিয়া, কালোজিরা, মৌরি, জর্দা ইত্যাদি আর তাতেই এই বিপত্তি। জর্দার
আসল উপাদান হল তামাক পাতা, যাতে রয়েছে নিকোটিন (Nicotine) নামক মারাত্মক ক্ষতিকারক
উপাদান। সারাদিন এই পানমশলা দিয়া বার বার পান খাওয়ার ফলে মুখে ক্যানসারের মতো
রোগের জন্ম নিতে শুরু করে। ভারতে প্রতি বছর পঁচাত্তর থেকে আশি হাজার মানুষ মুখের
ক্যানসারে আক্রান্ত হয় (Report from NICPR)। নির্দিষ্ট পরিমাণ পান, সুপারি, চুন, খয়ের, মৌরি, এলাচ, লবঙ্গ
ইত্যাদি দিয়ে খেলে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে নিশ্চয় উপকারি কিন্তু নেশার জন্য তামাক
দিয়ে নিয়মিত ও বেশি পরিমাণে খেলে তা তো শুধু অপকারিই না, যন্ত্রণা ও মৃত্যুর জন্যও
দায়ী। আর তার জন্য পান সুপারির গুনাগুণকে কখনই অবজ্ঞা করা যায় না। তাদের মহৎ গুনের
জন্যই তো তারা প্রাচীন কাল থেকে দেবতার চরণে পূজিত হয়ে আসছে। প্রতিটি পূজা অর্চনার
মতো পবিত্র অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য প্রথম প্রয়োজন পান সুপারির। আসলে মানুষের
নোংরা কামনায় যদি তার পবিত্রতাকে হরণ করার চেষ্টা করা হয় তবে তাতে তো বিপদ ঘটবেই।
এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।